টাইগার টুরিজম অর্থাৎ বাঘ পর্যটনে মধ্যপ্রদেশকে পেছনে ফেলে দিয়েছে মহারাষ্ট্র! সাম্প্রতিককালে এমনটাই দাবি ছিল জনৈক মারাঠি পর্যটন ব্যবসায়ীর। সেইসঙ্গে আমন্ত্রণ সেই দাবি সরেজমিনে গিয়ে প্রত্যক্ষ করবার। মার্চ থেকে জুন এই চার মাস বাঘ দেখবার পিক সিজন, আবহাওয়ার উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাফারি টিকিটের চাহিদা তুঙ্গে উঠতে থাকে।
একটা সময় ছিল বাঘের জঙ্গলে গিয়ে হত্যে দিয়ে বসে থাকতে হতো, অনেক সময়ই তিন চারটে সাফারি করেও বাঘের দেখা মিলত না। সুন্দরবনে গত ২৫-৩০ বছরে অন্তত বার পঁচিশ গিয়েছি, কিন্তু কখনই বাঘ দেখবার প্রত্যাশাও করিনি। এমনকী করবেট-রণথম্ভর-কানহা-বান্ধবগড়েও বাঘ না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। ব্যাঘ্র দর্শন আর ভগবান দর্শন সমার্থক। ফলে বাঘকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভূত রোমাঞ্চ বলয়। আমরা সবাই বলতে এবং ভাবতেও ভালবাসতাম, বাঘের জঙ্গলে গিয়ে যে বাঘের দেখা পেতেই হবে তেমন কিন্তু নয়, বরং দেখবার মতো আরও অনেক কিছু আছে। জঙ্গলে বাঘ দেখবার চাইতে বাঘের উপস্থিতি ফিল করাটাই আসল থ্রিল। ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু সেসব ধারণা এখন পাল্টাচ্ছে বোধহয়। বাঘের সংখ্যা বাড়ছে। এখন সুন্দরবনে গেলেও ফটাফট বাঘের দেখা মিলছে। বাঘ জনগণকে দর্শন দিচ্ছে পিলভিট-সঞ্জয়-দুধওয়া-মেলঘাট-এর মতো জঙ্গলেও। আর মহারাষ্ট্র বনকর্তারা তো বোধহয় ঠিকই করেছেন, তাঁদের সব জঙ্গলই বাঘ দিয়ে ভরিয়ে দেবেন, সংরক্ষিত বনভূমিতে বাঘেরা নিশ্চিন্তে চরে বেড়াবে, তাদের খাদ্যের অভাব থাকবে না, আর মানুষকে বাঘ দেখিয়ে সবচেয়ে বেশি রোজগার করবেন তাঁরাই।

মহারাষ্ট্রের বাঘ বলতে মূলত বিদর্ভ অঞ্চল, সেই কারণে নাগপুরকে বলা হয় টাইগার ক্যাপিটাল অফ ইন্ডিয়া। আর বলাটা অত্যন্ত সঙ্গত। কারণ দেশের যে প্রান্ত থেকেই আসুন, বাঘ দেখার সূচনাকেন্দ্র ওই নাগপুর। নাগপুরের চারিদিকে বাঘের বসত। পূর্বে নাগজিরা, পশ্চিমে মেলঘাট, উত্তরে পেঞ্চ ও হাতের নাগালে মধ্যপ্রদেশের ব্যাঘ্র সাম্রাজ্য (কানহা-বান্ধবগড়-সঞ্জয়ডুবরি-পান্না), আর দক্ষিণে গেলে উমরেদ, টিপেশ্বর এবং দেশের সবচেয়ে বড় টাইগার রিজার্ভ তাডোবা-আন্ধেরি। যেখানেই যান সর্বত্র এখন বাঘের দেখা মিলছে, ফলত পর্যটকের ভিড় উপচে পড়ছে নাগপুরে।

মহারাষ্ট্রে তাই যে কোনও ব্যগ্র ব্যাঘ্রপ্রেমীর প্রথম গন্তব্য অবশ্যই হওয়া উচিত তাডোবা-আন্ধেরি। নাগপুর রেল স্টেশন বা এয়ারপোর্ট থেকে ভাড়া গাড়িতে ঘন্টা তিনেকের বা তার একটু বেশি রাস্তা, কাছাকাছি জেলা শহর চন্দ্রপুর। কলকাতা থেকে ইদানীংকার সমস্যা হলো নাগপুরের ফ্লাইট পৌছতে রাত সাড়ে দশটা বেজে যায়, আর সকালে পৌঁছোবার ট্রেন গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস হামেশাই লেট, বাকি ট্রেনগুলিও পৌছয় বিকেল বা রাতে। অতএব নাগপুরে এক রাতের অধিষ্ঠান ছাড়া উপায় নেই। পরদিন সকাল সকাল যাত্রা করাই সমীচীন। যাতে পরদিন বেলা এগারোটার মধ্যে হোটেল বা লজে পৌঁছে নাওয়াখাওয়া সেরে বিকেলের সাফারির জন্য রেডি হওয়া যায়।

অবশ্য সাফারি অগ্রিম বুকিং না করে তাডোবায় না যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। অনলাইনে ১২০ দিন আগে বুকিং খোলে এবং রেলের রিজার্ভেশন বুকিং-এর মতোই ফুস করে শেষ হয়ে যায়। নিজেরা ধৈর্য ধরে চেষ্টা করতেই পারেন। সাফারি বুকিং হয়ে গেলে তারপর রেল/বিমান এবং তারপর হোটেল বুক করবার পালা। তবে অনেকেই সেসবের ঝামেলা এড়াতে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য এজেন্সির দ্বারস্থ হন, যারা পিকআপ-ড্রপ থেকে শুরু করে বুকিং-থাকা-খাওয়া সবকিছুর সুবন্দোবস্ত করে দেন এবং ন্যায্য দামেই।

নাগপুরে পৌঁছলেই বুঝতে পারবেন দশ-বারো বছর আগেকার শহরের রূপ যেমন অনেকটাই বদলে গিয়েছে তেমনি তাডোবাতেও গত এক দশকে বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে। তাডোবা এখন পাঁচটি জোনে বিভক্ত, কোর ও বাফার মিলিয়ে গোটা সতের গেট। পর্যটক তো বটেই, গাইড, জিপসি ড্রাইভার সবার জন্য কড়া আইন, বনরক্ষীদের কঠোর নজরদারি, ফলে সর্বত্র চরম শৃঙ্খলাপরায়ণতা নজরে পড়ে। যদিও পুরো জঙ্গলের মাত্র কুড়ি শতাংশ অংশে পর্যটকের চলাফেরার অধিকার এবং তাও নির্দিষ্ট রুটের বাইরে কখনই নয়। বনকর্মীদের নজরদারিতে বন্যপ্রাণ যেমন স্বাধীন চলাফেরায় স্বচ্ছন্দ বোধ করে তেমনি টুরিস্টের সুরক্ষাও নিশ্চিত হয়। তাডোবার জঙ্গলে মোবাইল ফোন তাই কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, ধরা পড়লে ফাইন পাঁচ হাজার, ফলত বাঘের সঙ্গে সেলফি নেওয়ার ইচ্ছে অনেকেরই মাঠে মারা যায়।

গ্রীষ্মকালীন বিকেলের সাফারিতে প্রখর রোদ ও তপ্ত হাওয়ার হলকায় মাথা-নাক-চোখ-মুখ যথাযথ ঢেকে বেরনোই ভাল। সূর্যের তাপ কমলে ফেরার পথে সেগুলি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বটে, তবে একটাই রক্ষে, এখানে আর্দ্রতা প্রায় না থাকার ফলে ঘাম হয় না, তাই গরমের কষ্টকর অনুভূতি আমাদের বাংলার তুলনায় অনেক কম। জলতেষ্টা নিবারণের জন্য গাড়িতে নেওয়া হয় কুলার ভর্তি জল। সন্ধে থেকে রাত হয়ে পরেরদিন সকাল পর্যন্ত আবহাওয়া বড় মনোরম থাকে, গরমের লেশমাত্র থাকে না, এমনকী ভোরবেলার সাফারিতে খোলা জিপসিতে বসে ঈষৎ হিমেল কাঁপুনি অনুভূত হয়। সেদিক থেকে বিকেলের চাইতে সকালের সাফারি তুলনামূলকভাবে আরামদায়ক, ছবি তোলার জন্যও সুবিধেজনক।

তাডোবায় কোর এরিয়ার সাফারিতে বন্যপ্রাণের বৈচিত্র্য সত্যিই উল্লেখ করবার মতো। বড় বড় জলাশয়, বিস্তীর্ণ ঘাসজমিতে চিতল, সম্বর, বন্য শুয়োর প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। আর একটু কপাল ভাল হলে নীল গাই, চৌশিঙ্গা, ঢোল, লেপার্ডের ছবি পেয়ে যাবেন আপনার ক্যামেরায়। আর আছে পাখির বাহার, রুক্ষ লাল মাটির ব্যাকড্রপে এমন সব মন ভোলানো রঙের পাখি বিস্ময় জাগায়। তেমনি জলাশয়ে মেলে জলচর পাখি, কুমীর।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে আছেন তিনি, ব্যাঘ্র মহারাজ, জঙ্গলের বস, নিজের নিজের এলাকায়। তাডোবার জঙ্গলে বাঘের বর্তমান সংখ্যা নাকি ১২৫, তবে তাদের বেশির ভাগই থাকতে ভালোবাসে লোকচক্ষুর আড়ালে। তাদের মধ্যে কিছু থাকে যারা মানুষের হুড়োহুড়ি উত্তেজনাকে খুব একটা আমল দেয় না, কিংবা হয়ত পছন্দই করে, তাদেরই দর্শন মেলে হামেশা। জঙ্গলের প্রচলিত ভাষায় বলে মুভমেন্ট এবং সাইটিং। কখনও এইসব ‘মিশুকে বা অমায়িক’ বাঘদের দেখা যায় নিজের এলাকা মার্ক করতে, কখনও বসে বা শুয়ে বিশ্রাম নিতে, কখনও শিকারের আশায় কানখাড়া, কখনও বা ব্যস্ত শিকার ভক্ষণে। গাইড, চালক, বনকর্মীদের কাছে তাদের পরিচয় ও খ্যাতি তাদের ডাকনামে। সে খ্যাতি ছড়িয়ে যায় জঙ্গলের সীমানা পেরিয়ে বাইরে, দেশে দূরদেশে। তাদের অজান্তেই তাদের ছবি ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মোবাইলে, ক্যালেন্ডারে, পোস্টারে, বইপত্রে, রিলস ও তথ্যচিত্রে। ক্ষণিকের অতিথি হয়ে আসা টুপি মাথায় টুরিস্ট গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে মুগ্ধ হয়ে শোনে গাইডের ধারাভাষ্য, সেইসব বাঘেদের লড়াই কিংবা প্রেমের কাহিনি, কিংবা তাদের বাপ মায়ের ঠিকুজি। টুরিস্টের চোখে সব বাঘই দেখতে এক, কিন্তু তাদের গায়ের ডোরাকাটার ভিন্নতা দেখে তাদের চিনতে পারে কেবল তারাই যারা তাদের রোজ দেখে।

কোর এরিয়াতে তো বটেই, পিক সিজনে বাফার এরিয়াতেও বাঘের দেখা মেলে। সদ্যোজাত বাচ্চাদের সুরক্ষা দিতে মা-বাঘিনিরা এই সব বাফার এরিয়াই বেছে নেয়, যাতে বড় বাঘ এসে বাচ্চাদের মেরে না ফেলে। বাচ্চাদের বড় করে শিকার করতে না শেখানো পর্যন্ত মায়ের দায়িত্ব শেষ হয়না। অনেক সময় লড়াইতে এলাকাচ্যুত বাঘকেও দেখা যায় বাফার এরিয়াতে এসে থাকতে। বাফার এরিয়ার বাঘ-বাঘিনি-বাচ্চাদের উপর বন দপ্তরের নজর থাকে কড়া, বলাই বাহুল্য।
তাডোবায় অন্তত দুরাতের তিনদিনের সফরে এলে মোটামুটি গোটা চারেক সাফারিতে আপনার ব্যাঘ্র দর্শন হবেই, সে গ্যারান্টি আজকাল দিয়েই দেন টুর ম্যানেজাররা। অনেক সময় যখন প্রতি সাফারিতেই এক বা একাধিক সাইটিং হতে থাকে, তখন সত্যি সত্যিই বারবার উত্তেজিত হতে হতে বোধহয় ক্লান্তি বোধ আসে, কারণ এতটা আশা করে আসে না কেউই! রোজ শয়ে শয়ে ব্যাঘ্রপ্রেমীর আশা পূরণ করে চলেছে তাডোবা। এখানে বাঘেদের চলাফেরা বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখলে মনে হয়, এই জঙ্গলে সত্যিই ওরা জন্মের পর থেকেই যথেষ্ট সুরক্ষিত বোধ করে! কেবল বাঘ পর্যটনেই নয়, বাঘ সংরক্ষণেও দেশের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক হয়ে উঠেছে তাডোবা!
তাডোবার জঙ্গল, বন্যপ্রাণ, সাফারি বুকিং ইত্যাদি নিয়ে জানতে হলে লগ ইন করতে পারেন www.mytadoba.org