Satpurar Bagh

সাতপুরার বাঘ

শুদ্ধসত্ত্ব দাস

আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে, পাটা পিচে রান করে যত না আনন্দ, বিরাট কোহলি গাব্বার ফাস্ট পিচে কিংবা ডার্বানে সেঞ্চুরি করে বেশি আনন্দ পেয়েছে। কিংবা ইপিএল চ্যাম্পিয়ন ম্যানসিটি অনেক বেশি আনন্দ পায় যখন তারা চেলসিকে হারায় কিংবা আর্সেনালকে তাদের ঘরের মাটিতে গিয়ে হারিয়ে আসে। আসলে প্রতিপক্ষ বা পরিস্থিতি যত শক্ত হয়, জিতে ততোধিক আনন্দ। বাঘের জঙ্গলে গিয়ে বাঘ দেখাটাও ঠিক তেমনই। একসময় ঠিক করেছিলাম মধ্য ভারতের কোনও জঙ্গলে আর বাঘ দেখবো না। কারণ ইতিমধ্যেই বান্ধবগড়, কানহা, পেঞ্চ, পান্না, সঞ্জয় ডুবরিতে আমার বাঘ দেখা হয়ে গেছে, কোথাও কোথাও একাধিকবার। আমার মনে হয়েছে এই সব জঙ্গলে গিয়ে বাঘ দেখে না আসা মানে যেন টাইব্রেকারের পেনাল্টি শুট মিস করার মতোই। কিন্তু মধ্য ভারতেরই বেশ কিছু স্বল্প পরিচিত জঙ্গল আছে, যেখানে বাঘ দেখা অত সহজ নয়। তাই বন্ধুটি যখন ক্রিকেট ফুটবলের উদাহরণ দিল তখন ঠিক করেছিলাম এরপর অচেনা জঙ্গলগুলোতে বাঘ দেখাই হবে আমার প্রধান লক্ষ্য। ভারতের ৫৪টা ব্যঘ্র প্রকল্প ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম মধ্যপ্রদেশেই সাতপুরা বলে একটি টাইগার রিজার্ভ আছে। নাম শুনেছি কিন্তু কোনদিনও যাবার কথা ভাবি নি। বন্ধু বলল, “চল না গিয়ে দেখে আসি একবার। বাঘ দেখতে পাওয়া গেলে ভাল, না হলে জঙ্গলটাই শুধু দেখে আসব। নতুন জঙ্গল দেখব এটাই বা কম কি?” অনেক চিন্তাভাবনা তর্কবিতর্কের পর রাজি হয়ে গেলাম।

সাতপুরা যাব। কিন্তু যাব কী ভাবে? খুব কম লোকই গেছে চেনাজানার মধ্যে। কাউকে তেমন পেলামও না যে সাতপুরা গেছে। অগত্যা আমাদের ভরসা ইন্টারনেট। জানতে পারলাম নিকটবর্তী এয়ারপোর্ট ভোপাল অথবা নাগপুর। ভোপাল থেকে সাতপুরার মাধাই গেট লাগছে সাড়ে চার ঘন্টা। আর নাগপুর থেকে গেলে প্রায় সাড়ে ৬ ঘন্টার মত। আমরা ঠিক করলাম ভোপাল দিয়েই যাব। যাতে গাড়ির জার্নিটা একটু কম হয়। তবে ট্যুর শেষ করে আসার পর মনে হয়েছিল আমাদের পরিকল্পনা বেশ ভুল হয়েছে। কারণ নাগপুর থেকে যাওয়াই অনেক সহজ হতো। ক্লান্তি ও খরচা দুটোই কম লাগতো। সাফারি বুকিং, হোটেল বুকিং সমস্ত কিছুর দায়িত্ব আমার বন্ধু নিয়ে নিল। মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের পর্যটন সাইট খুলতে দেখা গেল ডিমান্ড প্রায় নেই। তাডোবা, বান্ধবগড়, কানহাতে যেমন প্রায় সাফারি বুকিং পাওয়াই যায় না সাতপুরা কিন্তু সেই অর্থে তেমন নয়। আমার বন্ধুর এক চেনাজানা ট্রাভেল এজেন্ট আছে, ও তার সাথে অনেকবার ভারতের বিভিন্ন জঙ্গলে গেছে। ও বলল, চল ওকেই বলে দিই। আমরা শুধু ফ্লাইটের টিকিটটা কাটব। ওর ধৈর্য বড্ড কম, তো সঙ্গে সঙ্গে ওকে ফোন করে দিল, বলল চারটে সাফারি বুক করতে। দুজনের জন্য।

যাতায়াতের টিকিটটা অবশ্য আমি বুক করলাম। আমাদের যাওয়ার টিকিট ছিল ভায়া বোম্বে আর আসার টিকিট ছিল ভায়া দিল্লি। লকডাউনের পর থেকে কলকাতা-ভোপালের সরাসরি ফ্লাইট আর চালু হয়নি। অগত্যা ভায়া ফ্লাইটের যাত্রী। আমরা ঠিক করেছিলাম দুটো চুর্না গেট দিয়ে সাফারি করব আর দুটো মাধাই গেট দিয়ে। নর্মদা নদীর দক্ষিণ দিকে প্রায় ১৩৫০ বর্গকিমি কোর জঙ্গল আর ৮০০ বর্গকিমি বাফার জঙ্গল নিয়ে বিস্তৃত এই জঙ্গল মধ্যপ্রদেশের প্রথম বায়োস্ফেয়ার রিজার্ভ। ৫২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩১ প্রজাতির উভচর আর ৩০০ প্রজাতির পাখির বাস এই জঙ্গলে। সাতপুরাতে প্রধানত ৩টি গেট আছে। চুর্না বা ভীমকুণ্ড, মাধাই আর পানারপানি বা পাঁচমারি। এখানে আছে চোদ্দ প্রজাতির বিরল প্রাণী। যার মধ্যে জায়ান্ট স্কুইরেল, ইন্ডিয়ান স্কিমার, ব্ল্যাক বিল্ড টার্ন উল্লেখযোগ্য। পাখিদের মধ্যে প্যারাডাইস ফ্লাই ক্যাচার বা দুধরাজ, মালাবার পায়েড হর্নবিল, মালাবার হুইসলিং থ্রাশ এখানে প্রচুর দেখা যায়। বৈচিত্র্যময় জঙ্গলের পাহাড়ের উঁচু অঞ্চলে শাল আর নিচুতে সেগুনের প্রাধান্য। আর এতো বৈচিত্রে ভরা জঙ্গলে রয়েছে ভাল্লুক, লেপার্ড বা চিতাবাঘ, আর অবশ্যই বাঘ। বাঘের সংখ্যা প্রায় ৬০। বেশিরভাগই নাকি তারা নন ট্যুরিজম এরিয়াতে থাকে।

আমার সাতপুরার বাঘেদের ব্যাপারে খুব কম জানার একটা কারণ অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়া। এখানকার বাঘের ছবি ফেসবুক ইন্সটাতে প্রায় আসে না বললেই চলে। তাই যেটুকু জেনেছি তা গাইডদের থেকেই। এই সময় মাধাই জোনে আছে Fireline female আর তার দ্বিতীয় লিটারের ৮ মাসের তিন বাচ্চা। আর ফায়ারলাইন ফিমেলের আগের লিটারের বাচ্চা কর‍ণ ও কিরণ। মেল টাইগারদের মধ্যে পাট্টান মেল। চুর্নাতে আছে মছলি ফিমেল, KT ফিমেল, রুদ্র মেল, শঙ্করা মেল, ত্রিধানা মেল, হার্টফেস ফিমেল। মাল্লুপুরা বলে যে জোন আছে তা যাওয়া যায় চুর্না দিয়ে আর এখানে রাজ করছে লায়লা ফিমেল আর তার তিন বাচ্চা, R2 মেল, ঝালাই ফিমেল। এই R2 এর আবার ভাই ছিল R1 যে প্রায়ই কিনা সাতপুরা ছেড়ে ১৫০ কিমি দূরের পেঞ্চের বাফারের দিকে চলে যেত। সাতপুরা টাইগার করিডোর-এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ পূর্ব দিকে পেঞ্চ আর দক্ষিণ পশ্চিমে মেলঘাট ব্যঘ্র প্রকল্পের সাথে যুক্ত। R1 কেন যে বার বার নিজের এলাকা ছেড়ে এতো দূরে যেত আর ফিরে আসতো তার কারণ জানা যায় নি। 

সাতপুরাতে বাঘের সংখ্যা একসময় কমে যায়, তাই মধ্যপ্রদেশ বন দপ্তর NTCA-এর সহায়তায় বান্ধবগড় থেকে সুখিয়া বলে একটি ফিমেল বাঘকে নিয়ে আসে সাতপুরাতে। যদিও এই বাঘটিকে দেখা যায় না যেহেতু নন ট্যুরিজম জোনে আছে। চুর্না গেটের সামনে কোনো থাকার জায়গা নেই। নিকটবর্তী হোমস্টে ৪০মিনিট দূরে। আমাদের দুটো চুর্না সাফারিতে প্রাপ্তি ছিল একটা সরোবরের জলে হরিণের দলের খেলা, ময়ূর, সম্বর হরিণ, গৌর আর ভাল্লুক। জঙ্গলে ঢোকার ১৫ মিনিটের মধ্যেই ভাল্লুক দেখে মন খুশ হয়ে গেছিল। তবে ভাল্লুকটা একটু ঝোপের দিকে ছিলো। রাস্তার দিকে আসে নি। ছবি অবশ্য ভাল ই পেয়েছি। আলো ছিল সুন্দর তাই ছবিও সুন্দর এল । তবে পরের দিন দ্বিতীয় সাফারিতে সকালবেলাতে একটা এলার্ম কল পেলাম। খুব জোড়ালো কল চলল । বুঝলাম বাঘ বা লেপার্ড আছে কাছাকাছি। কিছুক্ষণ পরে যখন বন্ধ হল এলার্ম কল তখন অন্যদিকে একটু দেখে আসতে গিয়ে বোকা বনে গেলাম। ফিরে এসে শুনলাম একটা গাড়ি চিতাবাঘ বা লেপার্ড দেখতে পেয়েছে। অর্থাৎ যার জন্য অপেক্ষা করছিলাম সে ছিল লেপার্ড, আর গাছে থাকার জন্য লাংগুরের দল ডাক দিয়ে অন্য পশুদেরকে সাবধান করছিল । বেশ আফশোস হচ্ছিল লেপার্ডটা এতো কাছ থেকে মিস করার জন্য। ৯০ মিনিটের খেলায় ০-০ গোলে ড্র চলছিল কিন্তু কিভাবে যেন ইঞ্জুরি টাইমে গোল খেয়ে গিয়ে ম্যাচটা হেরে-গেলাম-টাইপ ফিলিংস হতে লাগল। 

চুর্না শেষ করে আমরা চললাম মাধাই। প্রায় চার ঘন্টা যাত্রার পরে মাধাই পৌঁছালাম। এখানকার সাফারিটা একটু অন্যরকম। হোটেলের সামনেই গেণ্যয়া নদী। সবাইকে মোটরচালিত নৌকা করে ওপারে গিয়ে নামতে হয়। তারপর ওপারেই রাখা জিপ্সিতে উঠতে হয়। ভারতবর্ষের আর পাঁচটা জঙ্গলের থেকে বেশ আলাদা রকমের সাফারি। সাফারির গাইড শুরুতেই উঠেই যখন বলল “নমস্তে স্যার ম্যায় অভিনাশ আপকো সাতপুরা মে স্বাগত করতা হু অর কনফারমেশন দেতা হু আপলোগোকো টাইগার দিখায়েনগে।” এই রকম কনফিডেন্স শুনে সত্যি অবাক হয়ে গেলাম। জিপ্সি চলতে শুরু হল আর কথাবার্তায় জানলাম জঙ্গলের ভেতরে ড্যাম বলে কোনো জায়গায় ফায়ারলাইন ফিমেল কিল করেছে, রাস্তার থেকে ১৫-২০ ফুট দূরে সে কিল। গাইড ড্রাইভারকে বলল সময় নষ্ট না করে সোজা ড্যামের দিকে যেতে।

ভরদুপুরে আমরা যেমন ভাতঘুম দিই, বাঘেরাও বোধহয় তাই। সাইটিং স্পটে গিয়ে দেখি মা বাঘ ঘুমিয়ে কাত এক ঝোপের ভেতর। আর বাচ্চারাও কোথাও নেই। কিলের থেকে পচা গন্ধ আসছে। দেখলাম একটা গৌর বা ইন্ডিয়ান বাইসনের কিছু অংশ খাওয়া হয়ে গেছে। প্রায় ঘণ্টা খানেক পর বাচ্চারা বের হল। এবং খেতে শুরু করল। আর নিজেরা খুনসুটি করতে শুরু করল। ইতিমধ্যে মায়েরও ঘুম ভাঙ্গল, বাচ্চারা মায়ের কাছে গিয়ে আদর খেতে থাকল। কিল, বাচ্চা আর মা একটু ঝোপের ভেতর থাকায় ছবি পরিষ্কার এল না। তবে চোখ জুড়িয়ে গেল।

ছবি তুলে মন জুড়িয়ে গেল পরের দিন সকালের সাফারিতে। গেটে এন্ট্রিতে আমরাই ছিলাম প্র্থম গাড়ি, আর সাইটিং স্পটে পৌঁছেছিলাম আমরাই আগে। কেউ নেই। গিয়েই দেখি ফাঁকাতে দুই ভাই আর এক বোন খেলে বেড়াচ্ছে। প্রায় রাস্তার ধারেই। মা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর রাখছে। ওয়াইল্ড বোর বা বন্য শুকরের দলকে দুই ভাই চেষ্টা করল শিকার করার কিন্তু না পেরে শুধু তাড়িয়ে দিল দলটাকে। এখানে মায়ের ভূমিকাতে একটু অবাক হলাম। ভেবেছিলাম হয়তো শিকার করতে সাহায্য করবে। কিন্তু কিছুই করল না। হয়তো বাচ্ছাদের স্বাবলম্বী হওয়া অবধি অপেক্ষা করছে। সেদিন প্রায় দু ঘণ্টা ধরে বাঘ দেখে তার মন ভরে ছবি নিয়ে অন্যদিকে জিপ্সি নিয়ে ঘুরতে গেলাম। মিনিট পাঁচেক গিয়েই জোড়া ভাল্লুক। ভগবান যেন উপুড় করে ঢেলে দিয়েছিল সেদিন। পাঁচফুট দূর থেকে ভাল্লুকগুলোকে দেখলাম রাস্তার সামনে। প্রায় ২০ মিনিট ধরে দুই ভাল্লুক। ঝকঝকে রোদ ঝলমলে আকাশ, তাই ছবিও ভাল হল।

তবে সেদিন আমাদের ফেরার তাড়া ছিল কারণ বিকালেই ফেরার ফ্লাইট ভোপাল থেকে ভায়া দিল্লি হয়ে। শুক্রবার রাতে কলকাতার অফিস থেকে চলে গিয়েছিলাম আর ফিরেছিলাম মঙ্গলবার সকালবেলা। শনিবার বিকালে আমাদের সাফারি ছিল চুর্না গেটে। রবিবার সকালবেলা চুর্নাতে তারপর সাফারি করে আমরা চলে এসেছিলাম মাধাই গেটে। মাধাইতে রবিবার বিকালে আর সোমবার সকালে সাফারি। তারপর লাঞ্চ করে আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম হোটেল থেকে। বিকেলবেলা আমাদের ফ্লাইট ছিল ভোপাল থেকে ভায়া দিল্লি হয়ে এবং রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ কলকাতায় ল্যান্ডিং ছিল। বুঝেই গেছিলাম খুব হেকটিক ট্যুর হতে চলেছে। তবু ছোট্ট ঝটিকা সফর, প্রায় পরিকল্পনা না করেই যাওয়া। প্রাপ্তি বলতে নতুন এক জঙ্গল দেখা আর নতুন জঙ্গলে অনেক পশুপাখির সাথে তিনটে ভাল্লুক আর চারটে বাঘ। মন্দ নয় কী বলেন!

মনে রাখবেন : ১) সাতপুরাতে সাফারি করতে গেলে মাধাই থেকেই চূর্না সাফারি করতে পারবেন, আমাদের মতো ভূল করবেন না যে চূর্না গেট দিয়েই জঙ্গলে ঢুকতে হবে। ২) বিমান হলে কলকাতা থেকে নাগপুর টিকিট কাটুন অথবা হাওড়া থেকে ভুপাল ট্রেনে যান। ৩) সাফারি বুক করুন মধ্যপ্রদেশ বনদপ্তরের পোর্টাল থেকে। https://forest.mponline.gov.in/Search.aspx?park=5

সাম্প্রতিক সংযোজিত প্রতিবেদন

দ্রষ্টব্যঃ এই ওয়েব ম্যাগাজিনে কিছু ছবি ইন্টারনেট থেকে ব্যবহৃত হতে পারে। তাদের দিকে আমাদের আত্মিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এই ম্যাগাজিনে তথ্য এবং মন্তব্যসমূহ লেখক/লেখিকাদের দ্বারা প্রদান করা হয়েছে, প্রকাশক/সম্পাদক কোনো বার্তা, মন্তব্য, ভুল অথবা বিষয় অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে কোনও দায়বদ্ধতা গ্রহণ করেন না।
কপিরাইট © ২০২৫.
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত: রংরুট.কম
ডিজাইন ও ডেভেলপ করেছে: উইকিইন্ড
রক্ষণাবেক্ষণ: টিম রংরুট