Naga Gramin Baromashya

নাগা গ্রামীণ বারোমাস্যা

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ কলকাতা থেকে উড়ান ছিল AI 709 ডিমাপুরের উদ্দেশে। সেখান থেকে ২১২৫ মিটার উঁচুতে এক প্রত্যন্ত অখ্যাত গ্রামে। যার নাম খোমি। সেখানেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম কোভিড দু:সময়ের দু-দুটি বছর। ডিমাপুর নেমেই প্রাণ গেল জুড়িয়ে, কোথায় প্রাণের শহরের মে মাসের হাঁসফাস গরম, আর এখানে ২৮ ডিগ্রি তাপমান। পরদিন মধ্য মে মাসের এক ফ্যাকফেকে সকাল সাড়ে ছ’টায় বেরিয়ে পড়া গেল আমার ultimate destination-এর দিকে।

উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত বোনের দেশের, এক অন্যতম দেশে। নাগাল্যান্ড মানেই এক গা ছমছম করা মিশ্র অনুভূতি। কৃষ্টি, সংস্কৃতি, দেশাচার, জনজীবন, জাতি, উপজাতি একদমই আলাদা আমাদের কাছে। কিন্তু সেই শব্দবন্ধ Incredible India মিলিয়ে দিয়েছে আমাদের এই সুবিশাল দেশ ভারতবর্ষকে।

কথা বলতে বলতে পার হয়ে গেলাম ভোরের ডিমাপুর শহর। আমার যাত্রাসঙ্গী ছিলেন সপরিবারে শ্রী ইন্নুকুটিয়া প্রতাপ। যিনি এসেছেন হায়দ্রাবাদ থেকে আমাদের কর্মযজ্ঞের অংশীদার হয়ে। কিছুটা গিয়েই উত্তরপূর্বের হিমালয় আমাদের স্বাগত
জানালো। রাস্তা চলেছে রাজধানী কোহিমার দিকে। প্রায় দু'ঘন্টা পাহাড়ি রাস্তার পাকদন্ডি পেরিয়ে চাকাবামা নামে এক পাহাড়ি গ্রামে থামা হলো সাময়িক চা বিরতির জন্য। সেখানে দেখলাম এক বিশাল সামরিক ছাউনি। গাড়ি থেকে নামতেই অভ্যর্থনা জানালো এক ঝলক কনকনে হিমেল হাওয়া হাওয়া ও বৃষ্টি। আধ ঘণ্টা চা বিরতির পরে আবারও চলা শুরু ফুসরো নামে এক জনপদের দিকে। কোহিমা থেকে যার দূরত্ব ৬৫ কিলোমিটার।

ফুসরো - আমাদের শকট চালক শ্রী কেজিনো ভেরো জানালেন ২১৩৬ মিটার উচ্চতায় নাগাল্যান্ডের এই ফেক জেলায় উচ্চতম উপশহর। সাধারণ তাপমাত্রা ঘোরাফেরা করে ১৮-২৭ ডিগ্রির মধ্যে, যা শীতের তিন মাসে নেমে যায় শূন্য থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে। জনসংখ্যা ১৫০০০ মতন।

অজস্র ফুল এই ফুসরো শহরে। ফুল কাকে বলে। রাস্তায় পাশে অবহেলায় ফুটে রয়েছে গোলাপ, রকম বেরকম দামি দামি মরশুমী ফুল, যা আমরা এই পোড়া কলকাতায় দেখি কত কষ্ট করে। এখানেই তা চোখের আরাম প্রাণের আনন্দ দিয়ে ফুটে রয়েছে। অনির্বচনীয়। এখানেই থামা নয়, আরও ৪০ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পেরিয়ে অবশেষে আসা হলো আপার খোমি গ্রামে। সেখানেই আমার সংস্থার সাইট অফিস ও অতিথিশালা। আপাত ও ভবিষ্যত বাসস্থল। বেলা প্রায় দু'টো বাজে তখন।

নাগাল্যান্ড মানেই অন্যরকম অনুভূতি। The land of head hunters। সত্যিই কি তাইই এখন? মঙ্গোলীয় শারীরিক গঠনের মানুষেরা যারা প্রকৃতির বিরুদ্ধে সদাসর্বদা কঠোর পরিশ্রম করে বেঁচে আছে, তাদের রয়েছে এক নিজস্ব আত্মমর্যাদা ও গোষ্ঠীগত বিশ্বাস যুগান্ত ধরে। ১৭টি উপজাতিতে বিভক্ত এই নাগাদের ভারতীয় মূলস্রোতে নিয়ে আসতে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। তার জন্য অনেক রক্তপাত হয়েছে, আবারও অন্যদিকে খ্রিস্টান মিশনারীরাও যুগপৎ সাহায্য করেছেন। বলতে গেলে এখন নাগাল্যান্ডের অধিবাসীদের প্রধান ধর্ম একটাই, ব্যাপটিস্ট খ্রিস্টান। গ্রামে গ্রামে গীর্জা। লেখা রয়েছে সেখানে Christian Village। তবে এই উপজাতি ভিত্তিক রাজ্যটির প্রত্যেক জেলায় আলাদা আলাদা সংস্কৃতি। এই ফেক জেলার অধিবাসীরা চাকাসাং উপজাতির লোক। তাদের প্রধান কথ্যভাষা চোকরী ও দ্বিতীয় ভাষা নাগামিজ। এই ভাষা আবার পাশের জেলার আও বা আঙ্গামী উপজাতিদের ভাষা ও চালচলন থেকে ভিন্ন। শিক্ষার প্রসার ৯০ শতাংশ। যার প্রধান অবদান ব্যাপটিস্ট মিশনারীদের। পড়া বা লেখার হরফ সম্পুর্ণ ইংরেজি। কারণ আগে এদের কোনও লেখার বা ভাবপ্রকাশের হরফ ছিলো না।

আপার খোমি গ্রামে কুয়াশাঘন মে মাসের এক সকালে আলাপ হলো গ্রাম সংসদের দুই প্রধান Nuvecho Vero ও Suzevo Vero র সঙ্গে। সাথীরা আলাপ করালেন গ্রামের স্কুলের দুই শিক্ষক Shepo Nieno ও Kuhoukhui Vezhu এর সঙ্গে।

এই খোমি অঞ্চল তিনটি গ্রামের সমষ্টি। আপার খোমি, মিডল খোমি ও লোয়ার খোমি। এক উপত্যকায় উপর থেকে নীচে ধাপে ধাপে নেমে গিয়েছে এই গ্রামগুলি। আপার খোমি গ্রাম সবচাইতে বর্ধিষ্ণু। প্রায় সাড়ে আটশো লোকের এই বসতিতে আছে একটা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, সেকেন্ডারি স্কুল ও চারটে মিডল স্কুল, দুটো গীর্জা। গ্রামে বিদ্যুৎ প্রায় সারাদিন থাকে। সকাল হয় খুব তাড়াতাড়ি, সেজন্য কাজ শুরু হয় সেই সাত সকালে। মানুষদের অন্যতম প্রধান উপার্জন চাষ আবাদ থেকে। সেখানে চাষ হচ্ছে ধান, ভুট্টা। পাহাড়ের ঢালে ঢালে Stepped Cultivation। এই চাষে কোনও রাসায়নিক সারের ব্যবহার নেই, পুরোপুরি ভাবে জৈবিক। ভুট্টা পেকে যায় আগস্ট মাসে। ধান আরও মাস তিন পরে অক্টোবর মাসে। গ্রামে রয়েছে কমিউনিটি গ্র‍্যানারি। প্রত্যেক পরিবার থেকে উপার্জিত শস্যের কিছুটা অংশ রেখে দেওয়া হয় ভবিষ্যতের জন্য সেখানে। কারণ আগস্ট থেকে অক্টোবর, দীর্ঘ বর্ষার মাস।

কাঠের বাড়িতে বাস, রান্নাবান্না কাঠের জ্বালে যেহেতু অপর্যাপ্ত কাঠ। রবিবার দিন গীর্জায় সকালের প্রার্থনার পরে অলিখিত কারফিউ। মে-জুন মাসে পাহাড়ের পাশে পাশে ফলের গাছে ফলে রয়েছে মহার্ঘ্য বিদেশি ফল অপর্যাপ্ত - তা হলো প্লাম। রয়েছে পীচ, ন্যাশপাতি, ডালিম।

অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে বর্ষা শেষ। ফসল ক্ষেতে পরিপূর্ণ। আকাশ পরিস্কার। গ্রামে গ্রামে নতুন ফসল কাটা ও পুরনো ফসল রোদে রেখে শুকনোর ব্যবস্থা করা হয়। চাষবাসে পুরুষ ও নারীর সহাবস্থান।

তীব্র শীত আসে নভেম্বর মাস নাগাদ। তার থেকে বাঁচার জন্য চাই আগুন। তার ব্যবস্থা করা হয় জঙ্গল থেকে শুকনো কাঠ কেটে এনে বাড়িতে জড়ো করে। প্রতিটি বাড়িতে একই ব্যবস্থা। শীতকাল এক কঠিন সময়। শূন্যের কাছাকাছি দীর্ঘ সময় ধরে। সারাদিন মেঘলা, ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে জীবন যাত্রা। কী কঠোর প্রকৃতি এই পাহাড়ি অঞ্চলে। এর মধ্যে আসে উৎসব গ্রামে গ্রামে। জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি Sukrunye (সংক্রান্তি) উৎসব পালন করা হয়। আগামী বছরকে আহ্বান করা হয়ে থাকে যাতে সে নবদিশার, নবআনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। গ্রামের পুরুষ ও নব্য যুবকেরা এই উৎসবে মুখ্য অংশ গ্রহণ করে। খুব সকালে সূর্য উঠবার আগে গ্রামের পুরুষরা দলবদ্ধ ভাবে কাছাকাছি এক পাহাড়ি ঝরণাতে গিয়ে দেহশুদ্ধি করে স্নান করে, তারা শুদ্ধি করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র, চাষের যন্ত্রপাতি এই বিশ্বাসে যে এই স্নানের সঙ্গে গত বছরের সমস্ত রকম দুর্ভাগ্য দূর হয়ে এক আনন্দময় সৌভাগ্য পূর্ণ সময় আসবে। তারা সেখানে উৎসর্গ করে মিথুন ( গরু বা। মোষের মতন এক গৃহপালিত তৃণভোজী প্রাণী) ও মোরগ। তারপরে সারাদিন উৎসব নাচ, গান, স্থানীয় খাবার ইত্যাদি ইত্যাদি সহযোগে। এখানে গীর্জার কোনও অনুশাসন নেই, বরং আছে অলিখিত অনুমোদন এই দেশাচার পালনের জন্য।

ফুসরো বা ফেক যে যে জনপদে গিয়েছি, সেখানে বেশিরভাগ ব্যবসা পাহাড়ি ও হিন্দিভাষীদের হাতে দেখেছি। কিছু কিছু বাঙালীও আছেন, তাঁদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। সিলেট অঞ্চলের লোক তাঁরা। পাহাড়িদের মধ্যে মহিলারাই কেনাকাটার ব্যবসায় ব্যস্ত। পুরুষরা রয়েছেন গাড়ি চালানো, কনস্ট্রাকশনের কাজে। প্রত্যেকটি জনপদ আপাত পরিস্কার ও সারাবছরেই ফুলের সমাহার সেখানে। আবহাওয়াও সঙ্গী এই ফুলের বাহারী সাজের জন্য।

তবে কোনও উড়ন্ত পাখি বা বন্যজন্তু দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কারণ শুনেছি যে এই জাত শিকারী। উপজাতিদের অন্যতম কাজ যে কোন জন্তু দেখলেই মেরে তাকে খেয়ে ফেলা। আদিমতম সেই প্রবৃত্তি এখনও চলে আসছে এখানে যতই সভ্যতার মোড়কে তাদের বাঁধা হোক। কেউ কি ভাবতে পারেন যুবকেরা প্রাণী হত্যার পরে তার তাজা রক্ত আঁজলা ভরে পান করছে। স্বচক্ষে দেখা, বীভৎস দৃশ্য।

রাজধানী কোহিমা শহরে গিয়ে দেখেছি দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধের স্মৃতি কোহিমা ওয়ার মেমোরিয়াল সিমেট্রি। এখানেই ১৯৪৪ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে জাপানি সেনাদের সঙ্গে ইংরেজ বাহিনীর মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল। সব মিলিয়ে দুটো বছর নগর সভ্যতার বিষবাষ্প থেকে বহু দূরে অনাবিল প্রকৃতির মাঝে দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছিল, ক্ষত বিক্ষত ফুসফুস ও হৃদয় নিরাময়ের জন্য যা যথেষ্ট বইকি।

সাম্প্রতিক সংযোজিত প্রতিবেদন

দ্রষ্টব্যঃ এই ওয়েব ম্যাগাজিনে কিছু ছবি ইন্টারনেট থেকে ব্যবহৃত হতে পারে। তাদের দিকে আমাদের আত্মিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এই ম্যাগাজিনে তথ্য এবং মন্তব্যসমূহ লেখক/লেখিকাদের দ্বারা প্রদান করা হয়েছে, প্রকাশক/সম্পাদক কোনো বার্তা, মন্তব্য, ভুল অথবা বিষয় অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে কোনও দায়বদ্ধতা গ্রহণ করেন না।
কপিরাইট © ২০২৫.
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত: রংরুট.কম
ডিজাইন ও ডেভেলপ করেছে: উইকিইন্ড
রক্ষণাবেক্ষণ: টিম রংরুট